গর্ভকালীন সময়ে কী খাবেন কী খাবেন না ।
গর্ভকালীন সময়ে খাওয়া-দাওয়া কেমন হবে চলুন জেনে নেয়া যাক
What To Eat and Drink During Pregnancy |
গর্ভকালীন সময় একজন মহিলার জীবনের সবচেয়ে সুখকর সময়। আরেকটি প্রাণ আপনার ভিতরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে ।তার চাই বেড়ে ওঠার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির যোগান। যা মাকেই দিতে হয় ।তাই গর্ভকালীন সময়ে একজন মহিলার চাই বাড়তি যত্ন ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ।
কারণ গর্ভে শিশুর পুষ্টির যোগান গর্ভবতী মাকে দিতে হবে ,আবার জন্মের পর শিশুটির দেখভাল মাকে করতে হবে। শিশু জন্মের পর একজন মহিলার নতুন আরেকটি পরিচয় হয় মা হিসেবে তখন তার দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়।
তাই গর্ভকালীন সময়ে সুস্থ থাকতে সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে এবং নিজে সুস্থ থাকতে একজন গর্ভবতী মহিলার প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার ।গর্ভকালীন সময় কিছু খাবার আবার ক্ষতির কারণ হয় ।
মা ও শিশু সুস্থতার জন্য একজন গর্ভবতী মহিলার কোন ধরনের খাবার খেতে হবে---
আমরা জানি গর্ভাবস্থায় পুষ্টি টা একটু বেশি নিতে হয় ।আসলে কোনগুলো বেশি নিতে হয় ?কোন খাবারটা গুরুত্বপূর্ণ? কোন খাবারগুলো বেশি খেতে হবে? কারণ প্রথম অবস্থায় একজন গর্ভবতী নারীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খুবই নাজুক থাকে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে শরীরের হরমোনাল পরিবর্তন আসে ফলে অনেক ধরনের সমস্যা দেখা যায় ।
অনেকে প্রথম তিন মাস কিছুই খেতে পারেনা। মর্নিং সিকনেস তো বেশি হয় তাই খাওয়ার জন্য চাপাচাপি না করে তাকে মানসিক সাপোর্ট বেশি দিতে হবে। কোন খাবারগুলো তার বেশি খাওয়া দরকার কেন খাওয়া দরকার ।সবার একটা স্বপ্ন থাকে সুস্থ ও সুন্দর শিশু জন্ম দেওয়ার।
এ সময়টা যখন আসে তখন সে চায় তার সন্তান টি ভালোভাবে দুনিয়াতে আসে। গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য একজন মা একলামসিয়া বা প্রি-একলামসিয়ার মতো সমস্যায় ভুগে থাকেন ।রক্তস্বল্পতা তীব্র আকার ধারণ করে।
কোন খাবার বেশি খেতে হবে ?কোন খাবারটা খেলে কতটুকু পুষ্টি পাবে?
অনেকে জানেনা কোন খাবার বেশি খেতে হবে ?কোন খাবারটা খেলে কতটুকু পুষ্টি পাবে ?
গর্ভাবস্থায় ওজন আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কতটুকু ওজন বাড়লে মায়ের জন্য ভালো। এটা জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। কোন খাবারটা কতটুকু পরিমান নিলে মা ও সন্তানের জন্য ভালো হবে। আমরা মনে করি গর্ভের সময় গর্ভবতী মহিলার বেশি খেতে হবে। তো কোন খাবার টা বেশি খেতে হবে ?বেশি করে ভাত বা রুটি খাওয়া?
আসলে প্রোটিনযুক্ত খাবার গুলো বেশি খেতে হবে। কারণ প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে যে ওজনটা হবে শরীর বিভিন্ন ধরনের যে ফ্যাট জমিয়ে দেওয়া সেটা হবে না। একজন গর্ভবতী নারীর গর্ভকালীন সময়ে প্রোটিনের চাহিদা টাই বেশি থাকে ,বাকি চাহিদা হচ্ছে কার্বোহাইড্রেট ,ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেল।
গর্ভাবস্থায় ভিটামিন ও মিনারেল গুলো একটু বেশি খেতে হয়
কারণ ভিটামিনযুক্ত খাবার গুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা মায়ের পূরণ হওয়ার পরে কিন্তু বাচ্চার শরীরে যাবে। তাই সন্তান সুস্থ হওয়ার জন্য মায়ের পুষ্টিটা খুবই জরুরি।
যখন থেকে গর্ভধারণের প্রস্তুতি নিবেন তখন থেকেই ফলিক এসিড বেশি খেতে হবে। যেমন সাইট্রাস যুক্ত যে ফলগুলো(মালটা) আছে সেগুলোতে ফলেট এর পরিমাণ বেশি থাকে ফলে গর্ভবতী মায়ের গর্ভ ধারণ ক্ষমতা বাড়ায় ,অকাল গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায় ।
এ সময় প্রয়োজন আয়রনযুক্ত খাবার
যে খাবার গুলোতে প্রোটিন বেশি থাকে সে খাবার গুলোতে আয়রনও বেশি থাকে ।
খাবারে সিস্টেমটা তিনটি ট্রাইমেস্টারে খেতে হয়।
- প্রথম তিন মাস ওজন বাড়েও না কমেও না। তাছাড়া অনেকের বমি হয় ,মর্নিং সিকনেস তো আছে, অনেকে কোন খাবারের গন্ধ নিতে পারেনা। তাই প্রথম তিন মাস তার পছন্দের যে খাবার আছে সেগুলোই খেতে উৎসাহিত করুন ।
কিন্তু চার মাস থেকে খাবারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে ।কারণ চারমাস পর থেকে ভ্রুণের গঠন শুরু হয়।
সেসময় প্রোটিনযুক্ত খাবার যেমন-- ডিম ,দুধ ,মাছ, মাংস, ডাল ,বাদাম ,বিচি জাতীয় খাবার গুলো প্রতিদিনের খাবার থাকতে হবে।
সপ্তাহে দুইদিন সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে ,অন্য যে দেশীয় মাছ আছে। ছোট মাছে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে। ছোট মাছ সপ্তাহে এক থেকে দুদিন থাকতে হবে । বেশি করে খেতে পারলে আরো ভালো। কেউ যদি ডিম খেতে না পারেন তবে ডিম বিভিন্ন ফরম্যাটে খেতে পারেন। স্যুপ করে ,সুজির সাথে ,পুডিং তৈরি করে আবার ডিমের জর্দা করেও খেতে পারেন ।
- কিছু কিছু খাবার আছে কম করে খেলে বেশি ক্যালোরি পাওয়া যায় যেমন -খেজুর ,প্রতিদিন দুইটা খেলেই ভাল ক্যালোরি পাওয়া যায় ,প্রচুর পরিমাণে মিনারেল ,ভিটামিন ,পটাশিয়াম ,আয়রন ।
যারা বমিটিং-এর জন্য খেতে পারছেন না তারা কখনই খাবারের মাঝখানে পানি পান করবেন না আবার খাবার টা শেষ করে সাথে সাথে পানি পান করবেন না। খাওয়ার এক থেকে দুই ঘন্টা পর থেকে পানি খাওয়া শুরু করুন ।এতে বমিটিংয়ের টেনডেনসি টা কমে যাবে ।
যদি প্রচুর গ্যাসের সমস্যা হয় তবে সব সময় শুকনো মুড়ি আস্তে আস্তে চাবাতে থাকবেন পানি দিয়ে খাবেন না। এতে গ্যাস আস্তে আস্তে কমে যাবে ।আবার মুড়ির পরিবর্তে টোস্টও খেতে পারেন ।তীব্র বমি হলে শুকনো খাবার খাবেন ।
সিজন অনুযায়ী খাবার ভাগ করতে হবে। কারণ গর্ভধারণটা ১০ মাস ধরে চলে। আমাদের দেশে এক এক ঋতুতে এক এক ধরনের ফল ও শাকসবজি পাওয়া যায় ।এজন্য দামেও সস্তা থাকে এবং পুষ্টি গুণ বেশি থাকে ।
একই কালারের সবজি সবসময় খাবেন না। কালার মিক্স করে খান। যেমন-শিম সবুজ আবার ফুলকপি সাদা , গাজর কমলা ,লাল শাক ।রঙের ভিন্নতার কারণে পুষ্টিগুণেও ভিন্নতা থাকে। প্রতিদিন একই রকম খাবার না খেয়ে একেক দিন একেক রকম ফল ও সবজি খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
কার্বোহাইড্রেট টা কম খেতে হবে। কার্বোহাইড্রেট বেশি খেলে ওজন বেড়ে যাবে ।এই সময়টাতে ফ্যাট পর্যাপ্ত পরিমাণে নিতে হবে ।কারণ ফ্যাটের চাহিদা গর্ভকালনি সময়ে বেশি থাকে ।
আয়রন যুক্ত খাবার খাওয়া টা খুব জরুরী ।পর্যাপ্ত আয়রন না খেলে গর্ভাবস্থায় অক্সিজেনের সাপ্লাই ঠিকমতো হবে না ।মা সঠিক ভাবে বাচ্চা প্রসব করতে পারবেন না ।
- সবজি ভালো করে ধুয়ে ,ঢাকনা দিয়ে রান্না করে খেতে হবে।
- সবজির টুকরো গুলো একটু বড় করে কাটার চেষ্টা করতে হবে। এতে পুষ্টিগুণ বজায় থাকবে।
- যেসব ফল চামড়াসহ খাওয়া যায় সেগুলো চামড়াসহ খেতে হবে।
ভিটামিন সি যুক্ত ফল প্রতিদিন একটি খেতেই হবে । অল্প অল্প করে সারাদিন সব ধরনের খাবার ভাঁগ করে খান ।একেবারে পেট ভর্তি করে সব খাবার খাবেন না । গর্ভধারণের পাঁচ মাস থেকে খাবারে বিভিন্ন ধরনের বাদাম যুক্ত করবেন। কারণ তখন থেকে বাচ্চার শরীরের বিভিন্ন অংশ বৃদ্ধি পায়। ব্রেইন ডেভলপমেন্ট ২৫% গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে ।
পরিবারের সবাই মনে সুখের আবে আসে একটি সুস্থ শিশুর জন্মের মধ্য দিয়ে। তাই গর্ভকালীন সময়ে পরিবারের সবার উচিত গর্ভবতীকে একটু বাড়তি যত্ন নেওয়ার।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে একক পরিবার বেশি দেখা যায়। তাই গর্ভকালীন সময়ে দেখা যায় বাসায় স্ত্রী একা থাকেন । স্বামী অফিসে বা ব্যবসার কাজে বাহিরে। তাই অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে গর্ভবতী মহিলার নিজেরই সচেতন হওয়া দরকার।
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
১ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
- দুগ্ধজাত পণ্য
- ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার
- হোল গ্রেইন বা গোটা শস্য জাতীয় খাবার
- ডিম ও মুরগি
- মাছ
- শাকসবজি
- বাদাম ও বীজ
- আয়োডিনযুক্ত লবণ
- কড লিভার ওয়েল
২ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
- ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
- জিংক সমৃদ্ধ খাবার
- চর্বি সমৃদ্ধ খাবার
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
- শাকসবজি
৩-মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
- ভিটামিন বি-৬ সমৃদ্ধ খাবার
- ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার
- ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার
- টাটকা ফল
- শাকসবজি
- কার্বোহাইড্রেট
- প্রোটিন জাতীয় খাবার
- দুগ্ধজাত পণ্য
- ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার
৫ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার।
- গোটা শস্য বা হোল গ্রেইন
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
- উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
- সালাদ
- ফল ইত্যাদি
৭ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
- আয়রন ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
- ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
- ডি এইচ এ সমৃদ্ধ খাবার
- ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
- ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার ইত্যাদি
৯ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
- ভিটাসিন সি সমৃদ্ধ খাবার
- ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার
- ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার
গর্ভকালীন সময়ে যে কোন সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। বর্তমান সময়ে ঘরে বসেই ফোনে ভিডিও কল করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া যায় এবং হোম ডেলিভারি সিস্টেম রয়েছে তাই কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে নিজের স্বাস্থ্যের এবং আপনার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে সচেতন হোন ।
স্বামীদের উচিত যতটা সম্ভব গর্ভকালীন সময়ে স্ত্রীদের ঠিকমতো দেখাশোনা করা। কর্ম ব্যস্ততা থাকলেও একটু সময় বের করে ফোন করে খোঁজখবর নেওয়া। আপনি যদি চাকরিজীবী মহিলা হন তবে যেকোনো সমস্যায় আপনার কলিগদের সহযোগিতা নিন। খাবার সঠিক সময়ে গ্রহণ করুন যত কর্মব্যস্ততা থাকুক না কেন ।
সবাই সুস্থ থাকবেন ,ভালো থাকবেন ।
আল্লাহ হাফেজ ।