গর্ভাবস্থায় যেসব লক্ষণ দেখলে চিকিৎসকের সরণাপন্ন হতে হবে।
গর্ভকালীন সময় এমনিতেই একজন গর্ভবতী নারীর জন্য একটি জটিল প্রক্রিয়া। নানাবিধ কারণে পরিবর্তন দেখা দেয় শরীর ও মনের। কিছু পরিবর্তন স্বাভাবিক আবার কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
গর্ভাবস্থায় যেসব বিপদ চিহ্ন বা লক্ষণ দেখলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
গর্ভকালীন সময়ে কিছু লক্ষণ স্বাভাবিক। সবার লক্ষণ গুলো একরকম হবে এমন কোন কথা নেই।আবার আপনার এক সন্তানের সময় শারীরিক পরিবর্তন যেমন ছিল অন্য সন্তানের বেলাতেও তাই হবে এমন নয়।
আরও পড়তে পারেন:
- গর্ভধারণের পূর্ব প্রস্তূতি কিভাবে নিবেন ? Pre Pregnancy Planning
- গর্ভকালীন সময়ে মা ও শিশুর যত্ন। Maternal and child care during pregnancy
- গর্ভকালীন সময়ে খাওয়া-দাওয়া কেমন হবে What To Eat and Drink During Pregnancy
চলুন জেনে নেই গর্ভকালীন সময়ে যেসব বিপদ চিহ্ন বা লক্ষণ অবহেলা করা যাবে না ---
১.অতিরিক্ত বমিঃ
গর্ভের প্রথম তিন মাস বেশিরভাগ গর্ভবতীদের কমবেশি বমি হয়ে থাকে । যদি অতিরিক্ত পরিমাণে এবং তিন মাসের পরও চলতে থাকে তবে এটা স্বাভাবিক থাকে না ।অতিরিক্ত ও দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা বমির ফলে গর্ভবতীর--
- পানিশূন্যতা হতে পারে ।
- শরীরের সোডিয়াম -পটাশিয়াম এর ভারসাম্যহীনতা হতে পারে।
- ওজন কমে যেতে পারে।
অতিরিক্ত এবং বেশি সময় ধরে বমি হলে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন ।
২.পেট ব্যথাঃ
গর্ভকালীন সময় গর্ভবতী মহিলারা এমনিতেই উৎকণ্ঠায় ভুগেন। এই সময়টাতে শরীরের অনেক অঙ্গের পরিবর্তন ঘটে ,জরায়ুর আকার বড় হয়, লিগামেন্ট হয় টানটান, বাচ্চার ওজন বাড়ার সাথে সাথে গর্ভবতী শরীরের পেশী ,জয়েন্ট এবং শিরার উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, অস্বস্তি বোধ হয়, অনেক সময় ব্যথা অনুভব হয়। তবে সব ব্যাথাকে স্বাভাবিক মনে করা উচিত নয় ।ব্যথা যদি অনেক বেশি হয় তবে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
ব্যাথা হওয়ার সাধারণ কারণ---
- লিগামেন্টের টান পড়লে।
- বেশি পরিশ্রম করলে।
- ক্রমবর্ধমান জরায়ু ।
- বৃত্তাকার লিগমেন্টের ব্যথা ।
- কোষ্ঠকাঠিন্য এবং গ্যাসের ব্যথা ।
ব্যাথা হওয়ার অস্বাভাবিক কারণ---
- গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা ।
- অপরিণত প্রসব যন্ত্রণা।
- যোনিপথে রক্তক্ষরণ ।
- প্রি-এক্মাম্পশিয়া ব্যথা (পেটের উপরের ডান দিকে পাঁজরের নিচে হয়ে থাকে) সাথে বমি বমি ভাব এবং মাথা ব্যথা হতে পারে ) ।
- ফাইব্রয়েডের বিকাশ ও রক্তক্ষরণ ।
- মূত্রনালীর সংক্রমণ।
- পেটের ভাইরাস ।
- গর্ভফুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে।
- কিডনিতে পাথর ।
- খাদ্য সংবেদনশীলতা ।
যে কারণেই হোক না কেন ব্যথা যদি অস্বাভাবিক হয় এবং বিশ্রাম নিলে না সারে তবে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যান।
৩.দৃষ্টিশক্তি সমস্যাঃ
গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের পরিবর্তন, বিপাকক্রিয়া, তরল ধারন এবং রক্ত প্রবাহের পরিবর্তন হয় ।তার কিছুটা প্রভাব গর্ভবতীর চোখ এবং চোখের দৃষ্টির উপর ফেলতে পারে ।
গর্ভাবস্থায় চোখের সমস্যাও মারাত্মক জটিল কোনো সমস্যার লক্ষণ হতে পারে ।প্রি-এক্লাম্পশিয়ায় আক্রান্ত ২০ ভাগ এবং এক্লাম্পশিয়ায় আক্রান্ত ৫০ ভাগ গর্ভবতীর চোখের দৃষ্টিশক্তি সমস্যা দেখা দেয় এবং ক্রমে তা বাড়তে থাকে ।
এসব সমস্যা হলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে---
- চোখে অন্ধকার দেখা ।
- সবকিছু ঝাপসা দেখা।
- আলো সহ্য করতে না পারা।
- হঠাৎ হঠাৎ চোখের দৃষ্টি লোপ পাওয়া।
- সবকিছু জোড়া দেখা।
- চোখ লাল হয়ে যাওয়া এবং চোখে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করা।
- চোখে চুলকানি এবং চোখ দিয়ে পানি পড়া।
যদি আপনার গর্ভাবস্থার পূর্ব থেকেই চোখের কোন সমস্যা থেকে থাকে তবে ডাক্তারকে তা স্পষ্ট করে বলতে হবে ।
৪.হাত-পা-মুখ (পুরো শরীর )ফুলে যাওয়াঃ
গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য ৫০ ভাগ বেশি রক্ত প্রবাহিত হয় ।এর জন্য শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ফুলে যেতে পারে। বলা যেতে পারে এটা স্বাভাবিক ।সাধারণত তৃতীয় ট্রাইমেস্টার থেকে শরীরে পানি আসা বা ফুলে যাওয়া লক্ষ্য করা যায় ।
শরীরে পানি আসা বা ফুলে যাওয়ার সাথে নিম্নোক্ত লক্ষণ থাকে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে---
- মাথা ব্যথা।
- দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা।
- ফোলা অংশে ব্যাথা অনুভব।
- দমবন্ধ অনুভূতি হওয়া।
এছাড়াও যদি অতিরিক্ত ফুলে যায়, চোখের চারপাশ এবং মুখে বেশি ফুলে যায় তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ।
৫.যোনিপথে হালকা বা ভারী রক্তস্রাবঃ
গর্ভাবস্থায় অনেকের হালকা বা বেশি রক্তক্ষরণ হতে পারে। অনেকে আবার গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও জটিলতা ছাড়াই সুস্থ শিশুর জন্ম দেন ।তবে ডাক্তারি পরীক্ষা না করা পর্যন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব নয় এটা কতটা গুরুতর ।
- যদি স্বাভাবিক মাসিক থেকে এই রক্তস্রাব এরকম না হয় , সাথে পেটের একপাশে একনাগাড়ে ব্যথা হয় ,তবে তা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ হওয়ার লক্ষণ ।
- পিঠে বা পেটে একটানা ব্যাথা সাথে অতিরিক্ত রক্তস্রাব হয় তবে তা গর্ভপাতের সম্ভাবনার লক্ষণ হতে পারে ।
৬.পানি ভাঙ্গাঃ
অনেক সময় প্রসব বেদনা উঠার পূর্বেই বা প্রসবের সময় হওয়ার পূর্বেই পানি ভাঙতে পারে ।যদি যোনিপথে পানির মত গন্ধ ও বর্ণহীন তরল নির্গত হয় তবে বুঝতে হবে পানি ভাঙ্গা শুরু হয়েছে ।অনেক সময় এটা কম পরিমাণে হতে পারে আবার বেশি পরিমাণে হতে পারে। যদি এই সমস্যা গর্ভাবস্থায় ৩৪ সপ্তাহের আগে ঘটে তবে বিপদজনক হতে পারে । দেরি না করে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন ।
৭.হঠাৎ করে পানি পিপাসা বেড়ে যাওয়াঃ
পানিশূন্যতা এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এর কারণে হতে পারে। উভয় প্রকার লক্ষণ গর্ভবতী এবং গর্ভস্থ শিশুর জটিলতা বারাতে পারে ।
৮.বাচ্চার নড়াচড়া কম মনে হলেঃ
২১ সপ্তাহের পর বাচ্চা দিনে কমপক্ষে ১০ বা তার অধিক বার নড়াচড়া করবে । যদি বাচ্চা নড়াচড়া ধীর হয়ে যায় বা নড়াচড়া না করে তাহলে বুঝতে হবে যে বাচ্চার কোন সমস্যা হয়েছে ।দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং নিশ্চিত হন কোন সমস্যা আছে কিনা ।
৯.জ্বরঃ
গর্ভকালীন সময়ে শরীরের হরমোনাল পরিবর্তনের জন্য গর্ভবতী মহিলাদের সব সময় জ্বর জ্বর অনুভূত হয়।এটা স্বাভাবিক ।জ্বর যদি ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি,তিন দিনেও না সারে তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন । জ্বরের সাথে যদি সর্দি কাশি না থাকে(ঠান্ডা জনিত জ্বর না হয়)তাহলে ইউরিন ইনফেকশন,বা কোন ধরনের সংক্রমণ থেকেও এমন হতে পারে ।অতিরিক্ত জ্বর আপনার গর্ভস্থ শিশুর জন্যও ক্ষতিকর ।
জ্বরের সাথে ---
- শ্বাস কষ্ট।
- পিঠের ব্যাথা।
- পেটে ব্যাথা।
- ঘাড় শক্ত অনুভব হওয়া ।
- শরীর ,হাত ,পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
- প্রস্রাবের রাস্তায় জ্বালা পোড়া করা।
- কাপুনি দিয়ে জ্বর ।
এসব লক্ষণ ও হতে পারে।
১০.দীর্ঘ সময় ধরে লেবার পেইনঃ
গর্ভবতীর প্রসবকালীন ব্যথা শুরু হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চা প্রসব না হলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। এর ফলে গর্ভবতী মহিলা ও তাঁর গর্ভস্থ বাচ্চার নানা সমস্যা হতে পারে ।
একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভকালীন সময় টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এ সময় ছোট থেকে বড় যে কোনো অস্বাভাবিক বিষয়ে তাকে খেয়াল রাখতে হবে ।যে কোন বিপদ চিহ্ন অবহেলা করা যাবে না ।আপনার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন কোন সমস্যা আছে কিনা সমস্যা না থাকলে তবেই নিশ্চিন্তে থাকুন ।
এ বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করতে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুন। অনেকের হয়তো উপকারে আসবে।
সবাই ভাল থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
আল্লাহ হাফেজ ।